আবদুল হামিদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ জুন ২০২২, ১২:৩৮ | প্রকাশিত : ০৮ জুন ২০২২, ১১:৩১
জমি হাতবদল, ফ্ল্যাট হস্তান্তর, নানা দাপ্তরিক কাজে প্রয়োজন পড়ে রেভিনিউ স্ট্যাম্পের। গুরুত্বপূর্ণ এই স্ট্যাম্প কেনাবেচায় তেমন কোনো তদারকি নেই। তাৎক্ষণিকভাবে চেনার সুবিধার্থে বিশেষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য না থাকায় আসল আর নকল স্ট্যাম্পের ফারাক করাও কঠিন।
এর সুযোগ নিয়ে জাল বা নকল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে জালিয়াতরা। ব্যাপকভাবে নকল হওয়ায় রেভিনিউ স্ট্যাম্পে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় ছোট টেবিল-চেয়ার নিয়ে স্ট্যাম্প বিক্রি করতে দেখা যায়। জেলা ও উপজেলা শহরের কোর্ট ও জমি রেজিস্ট্রেশন অফিস এলাকার চিত্রও একই।
রাজধানীসহ সারাদেশের কোর্টপাড়া এবং সাব-রেজিস্ট্রার অফিসকে ঘিরে সক্রিয় জাল স্ট্যাম্প সরবরাহকারী চক্র। তাদের সরবরাহ করা নকল স্ট্যাম্প ঢুকে পড়ছে আসলের ভিড়ে।
বিভিন্ন সময়ে জাল স্ট্যাম্প বিক্রির অভিযোগে প্রতারক চক্রের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে গত মে মাসে হাইকোর্টের অডিটরিয়াম ভবনের চারতলার একটি ভেন্ডার থেকে সিআইডি জাল স্ট্যাম্পসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মধ্যে বসে অবৈধ জাল স্ট্যাম্পের রমরমা বাণিজ্য ধরা পড়ার পর জালিয়াত চক্রকে ধরতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোটা চক্রের খোঁজে কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এছাড়া পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মধ্যে বসে অবৈধ জাল স্ট্যাম্পের রমরমা বাণিজ্য ধরা পড়ার পর জালিয়াত চক্রকে ধরতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোটা চক্রের খোঁজে কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এছাড়া পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানি।
সম্প্রতি দৈনিক বাংলা মোড়ে অভিযান চালিয়ে জাল স্ট্যাম্প ও কার্টিজ পেপারসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩। র্যাব বলছে, একটি জালিয়াত চক্র আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি করে কম মূল্যে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সরেজমিন দৈনিক বাংলা মোড়ে দেখা যায়, আগে সেখানে প্রায় অর্ধশত স্ট্যাম্প ভেন্ডার থাকলেও চারজন গ্রেপ্তারের পর সেখানে হাতে গোনা কয়েকটিতে স্ট্যাম্প বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানি বলেন, ‘গত সপ্তহে র্যাব চারজনকে গ্রেপ্তোরের পর এখানে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমি শুনেছি গ্রেপ্তার হওয়া চার জন জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করত।’
বায়তুল মোকারম মসজিদের উল্টো পাশে খাজা নাজিমুদ্দিন নামের এক স্ট্যাম্প ভেন্ডারকে দেখা যায়। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নিয়ম মেনে ব্যবসা করলে কোনো ভয় থাকে না।’ তবে নিবন্ধন খাতায় রেকর্ড না করেই স্ট্যাম্প বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, পরিচিত বিধায় দিয়েছেন পরে খাতায় তুলে নেবেন।
সিআইডি সূত্র বলছে, সম্প্রতি তারা জাল স্ট্যাম্পের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলাও হয়েছে। ছয়জনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। এক আসামির রিমান্ড চলমান।
সিআইডি বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর সহযোগিতায় হাইকোর্টে জাল স্ট্যাম্প সরবরাহ করে আসছিল। গত কয়েক বছর ধরে তারা এ ধরনের জাল স্ট্যাম্প ব্যবসায় জড়িত বলে স্বীকার করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির এক কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানান, স্ট্যাম্প জালিয়াত চক্রের মূলহোতাদের গ্রেপ্তার করতে হাইকোর্টের কড়া নির্দেশ রয়েছে। অভিযানসহ সব কিছু সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে হাইকোর্ট।
জাল স্ট্যাম্প চেনার উপায় কী জানতে চাইলে সিআইডির ওই কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটা চেনা সাধারণত খুবই কঠিন! তবে একটি পদ্ধতি আছে, অর্জিনাল স্ট্যাম্পে লেজার লাইট মারলে আলো বের হবে না যা নকল স্ট্যাম্পে বের হয়। ভিতরের মনোগ্রাম দেখেও চেনা যায়। এছাড়া স্ট্যাম্পেও টাকার মতো একটি সিরিয়াল নম্বর আছে। তবে লেজার লাইট ছাড়া সাধারণ মানুষের নকল আর জাল স্ট্যাম্প পার্থক্য করার কোনো উপায় নেই।
আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, স্ট্যাম্প সাধারণত কিনতে পাওয়া যায় না। ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে স্ট্যাম্প পায় সরকারি তালিকাভুক্ত ভেন্ডাররা। তাদেরকে স্ট্যাম্পের হিসাব ডিসি অফিসে তিন মাস অন্তর লেজার খাতাসহ জমা দিতে হয়।
তাদের ধারণা, স্ট্যাম্প কালোবাজারী হয় ছাপাখানা থেকে। সরকার একটা চাহিদা দিয়ে স্ট্যাম্প ছাপান, এই সময় ছাপাখানার কর্মকর্তারা চাহিদার চেয়ে বেশি ছাপিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করে।
ঢাকা সিএমএম কোর্টের কয়েকটি স্ট্যাম্প ভেন্ডারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারিভাবে স্ট্যাম্প ভেন্ডারের এজেন্ট হিসেবে তারা প্রতি তিন মাস পরপর ডিসি অফিসে লেজার খাতা দেখিয়ে হিসাব দিয়ে আসেন।
ওই হিসাবে প্রতিটি স্ট্যাম্পের বিষয়ে উল্লেখ থাকে। ফলে কেউ কোনো দিন জালিয়াতি করতে গেলে ধরা পড়তে হবে। তবে তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে কেউ কালোবাজারে বিক্রি করে কি না সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই এই ভেন্ডারদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ব্যাংকে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকার স্ট্যাম্প ব্যবহার হয়। গ্রাহকদের ঋণ এবং মর্গেজ করার জন্য স্ট্যাম্প বেশি ব্যবহার হয়। অনেকেই টাকা বাঁচাতে জাল স্ট্যাম্প ব্যবহার করছে।
র্যাবের একটি সূত্র বলছে, জাল স্ট্যাম্প রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরার দুটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রিন্ট করা হচ্ছে। তারপর ঢাকাসহ সারাদেশের স্ট্যাম্প ভেন্ডারদের কাছে চলে যাচ্ছে। একটি একশত টাকার স্ট্যাম্প মাত্র ৩৫-৪০ টাকায় কিনে খুচরা ১১০-১১৫টা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রত্যেকটি স্ট্যাম্পে একটি নিদিষ্ট নম্বর আছে। ওই নম্বর দেখে আসল নাকি নকল স্ট্যাম্প চেনা যায়। প্রতি বছর সরকার একটি নিদিষ্ট কোড ব্যবহার করে স্ট্যাম্প বাজারে ছাড়ে। এছাড়া কোন সালে কোন স্ট্যাম্প প্রকাশিত হয়েছে সেটা উল্লেখ থাকে। তবে তা খালি চোখে দেখা যায় না।
এদিকে স্ট্যাম্প জালিয়াতি চক্রের এই সদস্যরা অনেক আগের স্ট্যাম্প সংরক্ষণে রাখে। ওই পুরাতন স্ট্যাম্প একটির মূল্য ১০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে তারা। দৈনিক বাংলা মোড় থেকে গ্রেপ্তার ফরমান আলীর কাছ থেকেও এমন ২৫০টি পুরাতন স্ট্যাম্প উদ্ধার করেছে র্যাব।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘স্ট্যাম্প জালিয়াতির বিষয়টি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে। স্ট্যাম্প জালিয়াতি ঠেকাতে উৎপাদনস্থল খোঁজা হচ্ছে। এপর্যন্ত সিআইডি বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আশা করছি এই জালিয়াত চক্রের মূল উৎপাটন করা সম্ভব হবে।’
ইউভি লেজার লাইট ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম রব্বানি বলেন, ‘এটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। এটি একটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ।’
জানা গেছে, জজ কোর্টের সেরেস্তা বা ফাইল শাখা এই লাইটগুলো ব্যবহার করার সুয়োগ পাবেন। কারণ তারা প্রতিটি কেস ফাইল করার সময় এটার মাধ্যমে চেক করে ফাইলিং করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার (অতিরিক্ত জেলা জজ) মোয়াজ্জেম হোছাইন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হাইকোর্টের ফাইলিং শাখায় ইতোমধ্যে লেজার লাইটের ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন সিএমএম কোর্টসহ সারাদেশের জজ কোর্টগুলোতে এই স্ট্যাম্প জালিয়াতি ঠেকাতে লেজার লাইটের ব্যবহার শুরু হবে।’